ইউরোপের বিভিন্ন দেশে আসার প্রলোভনে দালালের খপ্পরে পরে পুড়ছে হাজারো বাংলাদেশী তরুণ-যুবকের স্বপ্ন । দীর্ঘ ছয় মাসের পথ পাড়ি দিয়ে ইউরোপে যান সিলেটের জকিগঞ্জের আব্দুস সামাদ। বিপদসঙ্কুল এই পথের প্রতিটি পদেই ছিল মৃত্যুর হাতছানি। আর কেউ যেন ইউরোপের স্বপ্নে বিভোর হয়ে এই মৃত্যু ফাঁদে পা না বাড়ান, সেই আহ্বান তার । আব্দুস সামাদ বলেন, সারাদিন জঙ্গলে শুয়ে থাকতাম আর সারারাত হাঁটতে হতো। টানা দশদিন এইরকম হাঁটতে হয় আমাদের। শেষ দুইদিনে হয় খাদ্য সঙ্কট। মারা যাওয়ার মতো পরিস্থিতিতে ছিলাম আমরা।
এই পথের আরেক যাত্রী সিলেটের ফিরোজ। একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা বললেন তিনিও। ফিরোজ বলেন, প্রায় দশদিন হাঁটার পর আমরা এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে ঢুকেছিলাম। এরপর আরও নানানভাবে ঘুরে আমাদের ইউরোপে ঢুকতে হয়েছে।
মে মাসে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকাডুবির ঘটনায় প্রাণ হারান ৬০ জনের বেশি অভিবাসন প্রত্যাশী। যার বেশির ভাগই বাংলাদেশি। এ অবস্থায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ইউরোপে পাড়ি জমানো বাংলাদেশির পরামর্শ, উচ্চাভিলাসী জীবনযাপনের স্বপ্নে বিভোর হয়ে আর যেন কেউ দালালের প্রলোভনে পা না বাড়ায়। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এমন বেশ কয়েকজন ভুক্তভোগী বলেন, ইউরোপের দালালদের টার্গেট বাংলাদেশী তরুণ-যুবকরা। আপনি যখন ইউরোপে পৌঁছান তখন আপনাকে রিসিভ করে এখানকার স্থানীয় বিদেশী দালাল, সে জানে আপনি ২৫০০ ইউরো সাথে এনেছেন, সে আপনার টাকা লোটার চিন্তায় থাকে।
আপনাকে রিসিভ করা বাবদ ১০০ ইউরো, ট্যাক্সি ভাড়া ৫০ ইউরো, তার বাসায় নিয়ে রাখবে ৬০-৭০ ইউরো, বাসায় তুলে দিবে ২০০-৩০০ ইউরো, হাউজ এগ্রিমেন্টের জন্য ৫০ ইউরো, মোট ৫০০ হতে ৬০০ ইউরো আপনার কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়। অথচ এখানে সর্বোচ্চ খরছ হচ্ছে ১২০ ইউরো। ফ্রান্সে আশ্রয় নেয়া মাসুদ তার অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, দালালদের খপ্পরে পড়ে ইউরোপে আসার স্বপ্ন এখন তার কাছে দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠছে।
ইতালিতে রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থী রোকন, আবিদ, সুজন, সাব্বির বলেন, স্বপ্নের ইউরোপ ঢুকতে গিয়ে মৃত্যুকে জয় করেছি। কিন্তু দালালদের মন জয় করতে পারি নি। ইউরোপে ঢোকার পথে বর্ডারে পুলিশের হাতে ধরা পড়লে বা পুলিশের জেরার মুখে দালাল সম্পর্কে কোন তথ্য দিলে তাদের সাথে থাকা অন্য যাদের দালালরা আটকে রেখেছে তাদের প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দিয়ে থাকে। ফিলিপস নামে একজন ইউরোপের দালালের সাথে কথা হলে সে জানায় যে, বাংলাদেশের সিলেট থেকে যে সমস্ত তরুণ-যুবক আসে তাদের কাছে প্রচুর টাকা থাকে এবং তারা দালালরা সেই জিনিসটা জানে বলে এই সুযোগে তাদের কাছ থেকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে বা প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে অনেক সময় সেই টাকাগুলো মুক্তিপণ হিসেবে আদায় করে নেয়। বাংলাদেশি তরুণ-যুবকরা সবসময় তাদের টার্গেটে থাকে বলে সে স্বীকার করে । বাস্তব চিত্র হলো ইউরোপে পৌঁছার পরও দালালদের ভয়ে অনেকেই মুখ খুলেন না। তাই পুলিশ প্রশাসন বস্তুনিষ্ঠ কোন তথ্য না পাওয়াতে দালালরা বরাবরই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।
জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থার (ইউএনএইচসিআর) তথ্য অনুযায়ী, ভূমধ্যসাগর দিয়ে যতো মানুষ প্রবেশ করেছেন, সেই তালিকার শীর্ষ দশ দেশের নাগরিকদের মধ্যে প্রায়ই বাংলাদেশও থাকছে। ইউএনএইচসিআরের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৪ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ১৯ লাখ ৫৮ হাজার ১২৬ জন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছেন৷ ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, গত আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক ২১ হাজার ৪৬০ বাংলাদেশি ইউরোপ গেছেন ২০১৫ সালে। অথচ ২০১৪ সালে ওই সংখ্যা ছিল ১০ হাজার ১৩৫। ২০১৩ সালে সংখ্যাটি ছিল ৯ হাজার ৪৯০ জন। ২০০৮, ২০০৯, ২০১০, ২০১১ ও ২০১২ সালে ওই সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ৭ হাজার ৮৫, ৮ হাজার ৮৭০, ৯ হাজার ৭৭৫, ১১ হাজার ২৬০ ও ১৫ হাজার ৩৬০ জন। এভাবে সাগরপথে আসতে গিয়ে শত শত মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু, তবুও ইউরোপে যাওয়ার চেষ্টা থেমে নেই৷ প্রশ্ন হলো কবে থামবে? আর কতো মানুষের প্রাণ গেলে হুঁশ ফিরবে আমাদের? আর কবে সচেতন হবে মানুষ? অনেক বাংলাদেশিরই জানা নেই, ইউরোপের পরিস্থিতি এখন ভিন্ন। ইউরোপ এখন আর অবৈধভাবে আসা লোকজনকে আশ্রয় দিতে রাজি নয়, বরং কাগজপত্রহীন মানুষগুলোকে নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে। এই তো বছর দুয়েক আগে ইউরোপ বলে বসলো, এক লাখ অবৈধ বাংলাদেশি আছে ইউরোপের দেশগুলোতে। তাদের ফিরিয়ে না নিলে ভিসা বন্ধের হুমকিও দিয়েছিলো ইউরোপ।
ফ্রান্সে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাইকমিশনার কাজী ইমতিয়াজ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, মিডিয়ার মাধ্যমে আমরা প্রতিনিয়ত দেখছি যে, বাংলাদেশিরা দালালদের খপ্পরে পড়ে সাগরপথ দিয়ে এসে একের পর এক জীবন বিলিয়ে দিচ্ছেন। আসলে এটা আমাদের কারো কাম্য না । আমাদের বাংলাদেশী বাবা-মাদের একটু সচেতন হবে হবে। তাদের সন্তানের ভবিষ্যতের জন্য তাদের স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে ইউরোপের আসার স্বপ্নে বিভোর শিক্ষিত তরুণ যুবকদের ইউনিভার্সিটি বা কলেজে লেখাপড়ায় আরো মনোযোগী হতে হবে। নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে ইউরোপের বিভিন্ন নাম করা ইউনিভার্সিটি থেকে একটা স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশে স্টুডেন্ট ভিসা নিতে নিজেকে প্রস্তুত করতে হবে অথবা কোন টুরিস্ট ভিসা বা ভিজিটর ভিসার জন্য আবেদন করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করে তারপর বৈধ পথ অবলম্বন করে ইউরোপে আসা উচিত বলে তিনি মনে করেন ।
জীবন বাজি রেখে নদীপথে এসে বাবা-মার বুক খালি না করতে তরুণদের এবং মিডিয়াকর্মীদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। ইউরোপের মিডিয়াকর্মীদের বস্তনিষ্ঠ এবং তথ্যভিত্তিক সংবাদ পরিবেশনের জন্য তিনি অনুরোধ করেন। মিডিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশের তরুণ যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে হবে কিভাবে বৈধ উপায়ে ইউরোপ আসা যায় । আর নিরুৎসাহিত করতে হবে দালালের খপ্পরে পড়ে সাগরপথে মৃত্যুর সাথে লড়ে ইউরোপে আসার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা থেকে। দালালদের দৌরাত্ম্য কমাতে তিনি বাংলাদেশীদের আরো সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন এবং এই দালালদের বিরুদ্ধে ইউরোপের পাশাপাশি বাংলাদেশ সরকার যথেষ্ট পদক্ষেপ নিচ্ছে।